হেদায়াতের সূচনা pdf for hardcover লেখক : আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যাহ রহ | Hedayater Shuchona By Imam Gajjali Rah:

হেদায়াতের সূচনা pdf read text
লেখক : আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যাহ রহ, আল্লামা ইবনুল জাওযী (রহঃ), হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী (রহ.)
প্রকাশনী : ইবাদাহ পাবলিকেশন
বিষয় : ইসলামী জ্ঞান চর্চা
অনুবাদক : শাকিল হোসাইন
পৃষ্ঠা : 176, কভার : পেপার ব্যাক
ভাষা : বাংলা

সাপ্লায়ার জানিয়েছেন এই বইটি 22 February 2022 এ প্রকাশিত হবে। প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে পণ্যটি পেতে আগেই অর্ডার করে রাখুন ।
Image


দ্বীন একটা সুবিশাল রাস্তা। এই রাস্তার প্রত্যেক অভিযাত্রীর শক্তি-সামর্থ্য, জ্ঞান-বুঝ, অবস্থা-পরিস্থিতি একেকরকম। এখানে কেউ দ্রুত এগিয়ে চলে, কেউ ধীরে ধীরে আগায়। প্রত্যেকেই যার যার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। দুঃখজনক হলেও দ্বীনের বুঝ পাওয়ার পর আমরা অনেকসময়ই খুঁটিনাটি আইনী বিষয়, আকীদাহর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়সহ নিজ নিজ মাসলাক ও মানহাযের গোত্রপ্রীতিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ি। এর কারণ আমরা দ্বীনের মাঝে অগ্রাধিকার বুঝে উঠতে পারি না। 

একেকজনের সামর্থ্য একেক রকম হলেও কিছু সাধারণ ভিত্তি দিয়েই প্রত্যেককে অগ্রসর হতে হয়। কিন্তু আমরা দ্বীনের চাহিদা ও দাবীর অগ্রাধিকার না বোঝার কারণে অনেক সময় ভুল বুঝি এবং অন্যকে ভুল পথে নিয়ে যাই। হেদায়াত পাওয়ার পর কি করতে হবে, কীভাবে করতে হবে, জীবনযাত্রা কীভাবে চালাতে হবে, কোন কোন গুণ অর্জন করতে হবে, কাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, কাকে বর্জন করতে হবে- এ নিয়েই এ বইটি। ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম সেরা তিনজন আত্মার চিকিৎসক আমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, পথ বাতলে দিচ্ছেন। আসুন সেই উপদেশ গ্রহণ করি, নিজে আলোকিত হই, অন্যদেরও আলোকিত করি।

অনুবাদকের কথা .......
আল্লাহর প্রশংসা ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরুদ ও সালাম দিয়ে আরম্ভ করছি। ইসলাম চিরসত্য। সত্যকে কখনো দমন করা যায় না। তবে কিছুদিন বা কিছু সময়ের জন্য এর অগ্রগতিকে কিছুটা শ্লথ করা যেতে পারে, এই যা। আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেক বাধা-বিপত্তি প্রোপাগান্ডা পেরিয়ে মানবজাতি বিশেষ করে যুবসমাজ সত্য ও সুন্দরের পথে আসছে, দ্বীন ইসলামের আলোর পথে অগ্রসর হচ্ছে। দীর্ঘদিন ঘুমকাতুরে থেকে এবার আস্তে আস্তে সেই নিদ্রা ভাঙছে অনেকের। অত্যন্ত আনন্দের কথা।

কিন্তু সঠিক পথ পাবার পরে একে আজীবন ধরে রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষত এ যুগে এরকম চ্যালেঞ্জ আগেকার যেকোনো যুগ থেকে অনেক বেশি ও সূক্ষ্ম। এসকল প্রতিবন্ধকতাই মূলত দ্বীনের পথে টিকে থাকার পরীক্ষাস্বরুপ। দ্বীনের প্রবেশের পর আমরা কি করি? বেশিরভাগই প্রান্তিকতায় ডুবে যাই। কেউ ইখতিলাফী বিষয়াদি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করাকেই দ্বীনের মূল মনে করি, কেউ আকীদার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিতর্কে ডুব না দিলে দ্বীনকে অপরিপূর্ণ ভাবে, অন্যেরা আবার ছোট ছোট বিষয়ে অপরকে বিভ্রান্ত না ভাবলে দ্বীনের চাহিদাকে অপূর্ণ মনে করে, আবার কেউ দুনিয়াবিমুখতার নামে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। 

এগুলো তো ভেতরের চ্যালেঞ্জ, এছাড়াও বাহির থেকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ তো আসছেই। কিন্তু অনেক সময় আমরা বাহিরের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করতে পারলেও ভেতরের সমস্যাগুলোকে প্রান্তিকতাগুলোকে সঠিকভাবে চিনতে পারি না, তাই এর যথাযথ প্রতিকার করাও সম্ভবপর হয়ে ওঠে না অনেকসময়ই।

প্রয়োজন ছিলো ধীরে ধীরে অগ্রাধিকার অনুযায়ী ও নিজের সামর্থ্য মোতাবেক সঠিক পথ ধরে আগানোর। কিন্তু এরকমটা আমরা সচরাচর দেখি না। এর সমাধান হচ্ছে সঠিক জ্ঞানার্জন এবং একে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন। এই বইটা হেদায়াতের পথে কীভাবে অগ্রসর হতে হবে সে বিষয়ে সুন্দর রুপরেখা প্রণয়নে অনেক বড় সাহায্যকারী হতে পারে। এতে গাযালী, ইবনুল জাওযী ও ইবনুল কাইয়্যিমের মত বিশ্ববরেণ্য আলিমের লেখা আছে। তারা আমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন নানাভাবে, আমাদের করণীয় বাতলে দিচ্ছেন। আসুন আমরা তাদের উপদেশ গ্রহণ করি। জীবনে কাজে লাগাই। হেদায়াতের পথে টিকে থাকার পথটাকে মসৃণ করার চেষ্টা করি। আল্লাহই তাওফীকদাতা।

বিভিন্ন স্থানে কিছু কিছু কথা টীকায় যোগ করা হয়েছে অনুবাদকের পক্ষ থেকে, পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে। বিশেষত ইমাম গাযালীর অংশটিতে এরকমটা বেশি দেখা যাবে।

শেষে প্রকাশক ভাইকে ধন্যবাদ, আমাকে এই কাজের সুযোগ দেওয়ার জন্য। আল্লাহ যেন তাদের এই সাহিত্যিক খেদমতকে কবুল করেন এবং বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য সমৃদ্ধকরণের পেছনে তাদেরকে মজবুত ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার তাওফীক দান করেন, আমীন।

ইমাম গাযালী ফিকহের ক্ষেত্রে শাফিঈ মাযহাবপন্থী আলিম ছিলেন। এ কারণে ওযু, গোসল, তায়াম্মুম, নামাযের মাসআলাসহ অন্যান্য ফিকহী মতের ক্ষেত্রে এই বইতে তিনি যা উল্লেখ করেছেন তা শাফিঈ ফিকহের অবলম্বনেই। আমাদের দেশের অধিকাংশই হানাফী মাযহাবপন্থী। তাই এ বিষয়ে জেনে রাখা ভালো, যেহেতু এ দেশের লোক অধিকাংশই হানাফী, তাই গাযালীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভক্তির কারণে তাঁর ফিকহী মতামত অনুসরণ না করলেও চলবে। প্রত্যেকেই যার যার ফিকহ অনুযায়ী আমল করবেন।


লেখক আবু হামিদ আল-গাযালী জীবনী .....

আবু হামিদ আল-গাযালী ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম প্রাজ্ঞ আলিম, ফকীহ, রব্বানী দার্শনিক ও অন্তরের চিকিৎসক। তাঁকে নিয়ে মুসলিমরা তো বটেই এর পাশাপাশি অমুসলিম বিশেষজ্ঞরাও প্রচুর গবেষণা করেছে ও করছে। যদি বলা হয় শীর্ষ দশজন মুসলিমের নাম বলতে যাকে অমুসলিম জগত চেনে ও জানে- তবে নিঃসন্দেহে সেই তালিকায় গাযালীর নামটিও দেখা যাবে। তাঁর রচনাবলী যুগের পর যুগ মুসলিমদের আধ্যাত্মিক উন্নয়নে সাহায্য করছে, তেমনি অমুসলিমদের কাছে ইসলামী দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তিকতার অন্যতম সেরা উদাহরণ গাযালী। 

এমন একটি সময়ে তাঁর জন্ম যখন মুসলিম উম্মাহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। একদিক থেকে তাদের মাঝে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দলাদলি যেমন চরম পর্যায়ে ছিলো, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নানা দলের নানামুখী মত উম্মাহকে ভেতরে ভেতরে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। তিনি অতি অল্প বয়সে সেরা আলিম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে অন্তরের প্রশান্তি ও নিশ্চয়তা না থাকায় তিনি আপাতভাবে নিজেকে আড়াল করে নেন। এরপর থেকেই প্রকৃত গাযালী উঠে আসে। এর মাধ্যমে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিজের ইয়াকীনকে পুনরুদ্ধার করতে, ইলমের প্রকৃত উদ্দেশ্যের পথে নিজেকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। 

তিনি তৎকালীন সময়ে ইলমের নামে প্রচলিত বিতর্ক, মুনাজারা, শাখাগত মাসআলা ও কালামশাস্ত্রকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া, দর্শনের নামে ইসলামবিরোধী আকীদার অনুপ্রবেশ, মুসলিমদের দলাদলি ও একে অপরকে ইসলাম থেকে বের করে দেওয়া- এসকল কিছুকেই সংস্কারের জন্য চেষ্টা করেন। তিনি চেয়েছিলেন ইলমের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ফিরিয়ে আনতে। যেই ইলম উপকারী, যা আখিরাতের রাস্তা দেখায়, নিজের আখিরাত নিয়ে চিন্তায় মগ্ন থাকতে শিক্ষা দেয়, মুসলিমদের সামগ্রিক কল্যাণের পথ দেখায়, যা আল্লাহকে চেনায়, আকাশ ও পৃথিবীর রহস্য উন্মোচন করে, কুরআন-সুন্নাহর প্রকৃত অনুসারী করে, অগ্রাধিকার ও প্রাধান্যকে সংশোধন করে, পূর্ববর্তী নেককারদের পথে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকতে সাহায্য করে। এ কারণে তাঁকে ইসলামী ইতিহাসের একজন স্বীকৃত মুজাদ্দিদ বলা যায়।

‘ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ ‘কিমিয়ায়ে সাআদাহ’ ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’ ‘কানুনুত তাবীল' সহ নানা গ্রন্থ ও পুস্তিকা লেখনীর জগতে তাঁর নামকে চিরস্থায়ী করেছে। আল্লাহ তাঁর ওপর রহমত বর্ষণ করুন, জান্নাতে উঁচু স্থান দিন, আমীন।

লেখকের ভূমিকা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা, যেমন প্রশংসা তাঁর যোগ্য। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর রাসূল ও বান্দা মুহাম্মাদ এবং তাঁর পরিবার-পরিজন, সঙ্গী-সাথী ও তাঁদের পরে যারা এসেছে প্রত্যেকের ওপর।

হে পবিত্র ইলম শিক্ষায় আগ্রহী ব্যক্তি! তোমার মাঝে ইলমের প্রতি একনিষ্ঠ আকর্ষণ ও প্রগাঢ় তৃষ্ণা দেখা যাচ্ছে। জেনে রাখো! যদি এর পেছনে তোমার উদ্দেশ্য হয় প্রতিযোগীতা করা, প্রদর্শন করে বেড়ানো, মনোযোগ আকর্ষণ ও দুনিয়ার ভগ্নস্তূপের আবর্জনা কুড়ানো, তাহলে জেনে রাখো- তুমি দ্বীনকে অনর্থক সাব্যস্ত করা, নিজের আত্মাকে মলিন করা এবং পরকালের বিনিময়ে ইহজগত ক্রয়ের পথে অগ্রসর হচ্ছো।

তোমার বিনিময় শুন্য, ব্যবসায় মুনাফাহীন। এহেন পঙ্কিল কাজে যে তোমার শিক্ষক হবে সেও তোমার পাপকাজে সমান ভাগিদার। তোমার লোকসানে সেও অংশীদার। তার উদাহরণ হচ্ছে সেই ব্যক্তির মত, যে কিনা দুর্ধর্ষ ডাকাতকে তরবারী বিক্রি করেছে। যেমনটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

من أعان على معصية ولو بشطر كلمة كان شريكا فيها

“যে ব্যক্তি পাপকাজে অর্ধেক শব্দ দিয়েও সহায়তা করে সেও সেই পাপে অংশীদার।”মে

[১] এই শব্দে হাদীছ পাওয়া যায়নি। তবে একটি হাদীছে এসেছে এরকম, ‘যে কোনো মুমিনের হত্যায় সাহায্য করলো, একটি শব্দের অর্ধেক দিয়েও, সে এমনভাবে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে যখন তার চোখের মাঝখানে লেখা থাকবে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ' ইবনু মাজাহ, 262; সনদকে দুর্বল বলেছেন অনেকে।

কিন্তু যদি ইলম অন্বেষণের ক্ষেত্রে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তোমার ও আল্লাহর মাঝে থাকে, তোমার মনোযোগ যদি বর্ণনার মাধ্যমে তথ্য বৃদ্ধি করা না হয়ে হেদায়াত অন্বেষণ করা হয়ে থাকে- তবে তোমার জন্য সুসংবাদ, তুমি যখন পথ চলবে ফেরেশতারা তোমার জন্য দুআ করবেন ও সমুদ্রের মাছ পর্যন্তও তোমার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবে।

তোমার জেনে রাখা দরকার, হেদায়াত জ্ঞানের ফসল। হেদায়াতের প্রারম্ভ ও সমাপ্তি এবং বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক আছে। শুরু থেকে যাত্রা না করলে যেমন শেষে পৌঁছা যায় না, তেমনি অভ্যন্তরকেও আবিষ্কার করা যায় না যতক্ষণ না বাহ্যিকে উপনীত হওয়া যাচ্ছে।

তাই আমি তোমাকে ‘হেদায়াতের সূচনা’ পর্ব দেখাতে যাচ্ছি, যাতে তুমি তোমার অবস্থা ও প্রবৃত্তি সম্পর্কে জ্ঞাত হতে পারো। এরপর যদি তুমি এর দিকে প্রবৃত্ত হয়, নিজের মাঝে এর প্রতি আগ্রহ দেখতে পাও, তবে এর সমাপ্তির অন্বেষণ কোরো এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সমুদ্রে নিজেকে অবগাহন কোরো। আর যদি তোমার অন্তর প্রারম্ভই ইচ্ছুক না হয়, সাড়া দিতে প্রয়োজনের চাইতে অধিক সময় নেয়, তবে জেনে রেখো! তোমার নফসের যে অংশ জ্ঞানের প্রতি আকর্ষিত হয়েছে সেটা নফসে আম্মারাহ ওয়াস সু, অর্থাৎ, এমন অন্তর যা মন্দের দিকে ঝুঁকে থাকে, যা শয়তানের অনুসরণোদ্ভূত হয়ে থাকে। ধোঁকার রশিতে ঝুলিয়ে ধ্বংসের সুড়ঙ্গে ফেলে দেওয়াই তো শয়তানের কৌশল। সে চায় খারাপকে ভালোর মোড়কে উপস্থাপন করতে, যতক্ষণ না সে তোমাকে সেই দলের অন্তর্ভুক্ত করে যাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে,

قل هل ننبئكم بالأخسرين أعمالاً (301) الذين ضل سعيهم في الحياة الدنيا وهم يحسبون أنهم يحسنون صنعاً (401)

“বলো, আমি কি তোমাদেরকে এমন লোকদের কথা জানাবো, যাদের কর্মসমূহ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? (এরা তো তারাই) যাদের প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনে বিফল হয়েছে; অথচ তারা মনে করে যে, তারা ভালো কাজই করছে। ”মে

তোমার কাছে শয়তান এসে হাদীছে বর্ণিত ইলমের ফযীলত, আলিমদের মর্যাদা ইত্যাদি বলে বলে কুমন্ত্রণা দিতে শুরু করবে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সতর্কবাণী সম্পর্কে তোমাকে উদাসীন করে দেবে।

“ইলমের দিক থেকে বাড়লেও যার হেদায়াত বাড়ে না, সে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।”৷

“কিয়ামতের দিন সেই আলিম সবচাইতে কঠোর শাস্তি পাবে যাকে আল্লাহ তার ইলমের মাধ্যমে উপকৃত করেননি।”

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুআ করতেন,

اللهم إني أعوذ بك من علم لا ينفع، وقلب لا يخشع، وعمل لا يرفع، ودعاء لا يسمع

“হে আল্লাহ আপনার কাছে আশ্রয় চাই এমন ইলম থেকে যা উপকার করে না, সে হৃদয় থেকে যা ভীত হয় না ও সেই আমল থেকে যা উর্ধ্বারোহণ করে না।”

তিনি আরও বলেন, “মিরাজের দিন আমি এমন কিছু লোককে দেখি জাহান্নামের কাঁচি দিয়ে যাদের ঠোঁট কাটা হচ্ছিলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘এরা কারা?’ তারা উত্তরে বললেন,

كنا نأمر بالخير ولا نأتيه وننهى عن الشر ونأتيه

‘আমরা মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দিতাম, নিজেরা করতাম না। অন্যদেরকে মন্দ থেকে নিষেধ করতাম কিন্তু নিজেরাই সেই কাজ করতাম।”

হে নিঃস্ব ব্যক্তি! শয়তানের উপদেশ শ্রবণ ও তার ধোঁকার রশিতে পা দেওয়া থেকে সাবধান হও।

সেই অজ্ঞের জন্য আফসোস যে জ্ঞানার্জন করেনি, কিন্তু সেই জ্ঞানীর জন্য হাজারবার আফসোস যে জ্ঞান মোতাবেক আমল করলো না। আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন, জেনে রাখো ইলম অন্বেষণকারীরা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত।

প্রথম, যে ইলম অর্জন করে পরকালের পাথেয় সংগ্রহের জন্য, সে এর মাধ্যমে আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো সন্তুষ্টি ও সেই চিরস্থায়ী ঘর ব্যতিরেকে অন্য কিছুই কামনা করে না। এই ব্যক্তিই বিজয়ী ও সফল।

দ্বিতীয়, যার উদ্দেশ্য হয় দুনিয়াতে ভালো থাকা, দুনিয়ার সম্মান, অবস্থান ও ধনসম্পত্তি কিন্তু সে কি করছে সে ব্যাপারে সে জানে এবং অন্তরে অন্তরে সে অনুভব করে তার প্রকৃত অবস্থা ভালো নয়, তার নিয়্যাতও সঠিক নয়। এ ব্যক্তি নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। যদি সে তাওবা না করেই মৃত্যুবরণ করে, তবে আশঙ্কা আছে তার শেষ পরিণতি মন্দ হবে। তার চূড়ান্ত পরিণতি আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু মৃত্যুর নির্ধারিত সময় আসার আগেই যদি সে সঠিক পথ পায় ও তাওবা করে, সৎকর্ম বাড়িয়ে দেয় ও পূর্বেকার কর্মের জন্য অনুশোচনা বোধ করে তবে সেও সফলদের কাতারে জায়গা করে নেবে। কেননা,

“যে তাওবা করে সে তো তার মত যার কোনো পাপ নেই।”

তৃতীয়, যে পরিপূর্ণভাবে শয়তানের ধোঁকায় পতিত হয়ে গেছে। তার ইলম অর্জনের একমাত্র উদ্দেশ্য সম্পদ বৃদ্ধি, পদমর্যাদার উন্নতি, দম্ভ ও অহংকার করা এবং দুনিয়াতে অনুসারীর বিরাট দল তৈরী করা। সে এই ইলমের মাধ্যমেই সকল স্থানে যায় নিজের কামনা-বাসনা মেটানোর জন্য। এতকিছুর পরেও সে ভাবে আল্লাহর কাছে তার অবস্থান অনেক উঁচু, যেহেতু সে বাহ্যিকভাবে আলিমদের অনুসরণের ভান করে, তাঁদের মত পোশাক পরিধান করে ও তাঁদের মত কথা বলে; যেখানে তার উন্মত্ত বাসনা দুনিয়ার প্রতি ঝোঁকা, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে।

এই ব্যক্তি নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত, বোকা ও ধোঁকার শিকার। তার জন্য তাওবার আশাও নেই, কেননা সে ভাবছে সে তো ভালো কাজই করছে। এরুপ ব্যক্তিই মহান আল্লাহর সতর্কবাণীর ব্যাপারে উদাসীন,

يا أيها الذين آمنوا لم تقولون ما لا تفعلون (2) كبر مقتاً عند الله أن تقولوا ما لا تفعلون (3)
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করো না, তা বলো কেন? তোমরা যা করো না তা যে বলো, এটা আল্লাহর কাছে খুবই অপছন্দনীয়।”

এরাই সেই লোক যাদের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমি দাজ্জাল থেকেও একদলের ব্যাপারে অধিক আশঙ্কা করি।” লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, “তারা কারা হে আল্লাহর রাসূল?” তিনি বললেন, “মন্দ

আলিমরা।”৮ে]

কেননা দাজ্জালের লক্ষ্য মানুষকে বিভ্রান্ত করা। এ ধরণের আলিমরা কথার মাধ্যমে দুনিয়াবিমুখতার দিকে আহ্বান করলেও মানুষজন তাদের কাজকর্মের মাধ্যমে দুনিয়ামুখীতার শিক্ষাই পায়। আর কথার চাইতে কাজের শক্তি বেশি এবং মানুষের প্রকৃতিই এমন যে তারা কথার চাইতে কাজের অনুসরণ করতেই অধিক আকৃষ্ট হয়।

তার সুন্দর সুন্দর কথা দিয়ে সে আর কতটুকু উপকার করতে পারবে যেখানে তার আমল স্পষ্টভাবেই বিভ্রান্ত। সাধারণ মানুষ যখন দেখে আলিমরাই দুনিয়াপূজায় ব্যস্ত তখন তারাও দুনিয়ামুখী হয়ে পড়ে। এরুপ ভ্রান্ত আলিমদের জ্ঞানই আল্লাহর বান্দাদের অবাধ্যতায় লিপ্ত হতে সাহস যোগায়। তারপরেও তার অজ্ঞ নফস তার জ্ঞানের বিনিময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা, আশা আকাঙ্খা করে; মন্দের প্রতি আকর্ষিত নফস তারপরেও ভাবে সে আল্লাহর অনেক অনেক বান্দার চাইতে অনেক উত্তম।

তাই হে অন্বেষণকারী! তুমি প্রথম শ্রেণীর অন্বেষণকারী হও, কোনোমতেও দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হোয়ো না। কেননা কত দীর্ঘসূত্রিতা অবলম্বনকারী তাওবার আগেই মারা গেছে ও সবকিছু হারিয়েছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কোনোমতেই তৃতীয় শ্রেণীর কেউ হোয়ো না, যাদের জীবন যন্ত্রণাদায়ক, সাফল্য কিংবা মুক্তির কোনোপ্রকার সম্ভাবনাই তাদের মাঝে থাকে না।

তুমি জিজ্ঞেস করতে পারো, “আপনার বর্ণিত হেদায়াতের সেই সূচনা আসলে কি, যার মাধ্যমে আমি নিজেকে পরীক্ষা করে নিতে পারি?” জেনে রেখো! হেদায়াতের সূচনা বাহ্যিকভাবে তাকওয়া অবলম্বন এবং এর সমাপ্তি অভ্যন্তরীণ তাকওয়ার মাঝে। চূড়ান্ত সৌভাগ্য তাকওয়ার মাঝেই নিহিত, মুত্তাকী ছাড়া কেউই হেদায়াত লাভ করতে পারে না। তাকওয়া অর্থ আল্লাহর আদেশ-নির্দেশ মানা ও তিনি যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। বাহ্যিক তাকওয়ার দুটি অংশ আছে এবং এই উভয় অংশই আমি এখন তোমার নিকট বর্ণনা করতে যাচ্ছি।

আনুগত্য

জেনে রাখো! আল্লাহর আনুগত্য ফরয-আবশ্যিক ও নফল-ঐচ্ছিক এ দুইভাগে বিভক্ত। ফরয আমলসমূহ জীবনের মূল পুঁজি, এর মাধ্যমে চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন করা সম্ভব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

ما تقرب إلي المتقربون بمثل أداء ما افترضت عليهم، ولا يزال العبد يتقرب إلى ، الذي يسمع به، وبصره الذي يبصر بالنوافل حتى أحبه، فإذا أحببته كنت سمعه به، ولسانه الذي ينطق به، ويده التي يبطش بها، ورجله التي يمشي بها

“আমি যেসকল আমল আবশ্যিক করে দিয়েছি সেগুলো পালন করার মত আর কিছুর মাধ্যমে বান্দা আমার এত নৈকট্যে আসতে পারে না। বান্দা নফল আমলের মাধ্যমে আমার নিকটে আসতেই থাকে, এমনকি আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। তখন আমি বান্দার কান হয়ে যাই যা দিয়ে সে শোনে, চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে দেখে, জিহ্বা হয়ে যাই যা দিয়ে সে কথা বলে, হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে, পা হয়ে যাই যা দিয়ে সে চলে।”

হে হিদায়াতের অন্বেষণকারী! তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর আদেশ-নিষেধের অনুসরণ করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমার প্রতিটি মূহুর্ত, প্রত্যেকটি শ্বাস প্রশ্বাসে নিজ হৃদয় ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে নিবিড়ভাবে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারবে, জেগে ওঠা থেকে ঘুমানো পর্যন্ত। মনে রাখবে, আল্লাহ তোমার অন্তরের গোপনতম প্রকোষ্ঠের খবর পর্যন্তও জানেন। তাঁরই নিয়ন্ত্রণে আছে তোমার ভেতর ও বাহির। তোমার কোনো চিন্তা, কোনো একটি মূহুর্ত, কোনো পদক্ষেপ, তোমার প্রতিটি স্থিরতা ও গতিবিধি তাঁর জ্ঞানকে অতিক্রম করতে পারে না। তুমি মানুষের সাথে থাকো কিংবা নির্জনে, প্রতিটি ক্ষণেই তুমি তাঁর সামনেই রয়েছ। গোপন ও প্রকাশ্য জগত, প্রতিটি স্থির বস্তুর স্থিরতা, প্রতিটি গতিশীল বস্তুর গতিশীলতার ব্যাপারে আকাশ পৃথিবীর অধিপতি সেই মহান সত্তা জানেন।

يعلم خائنة الأعين وما تخفي الصدور

“তিনি চোখের চৌর্যবৃত্তি ও অন্তরের সুপ্ত কথা জানেন।”

يعلم السر وأخفى

“তিনি গোপন ও অধিকতর লুক্কায়িত বিষয়ও জানেন।”

হে নিঃস্ব ব্যক্তি! আল্লাহর সামনে নিজের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিষয়াদিকে শিষ্টাচার দিয়ে পূর্ণ করো। মহামহিম ও প্রবল প্রতাপশালী অধিপতির সামনে নিজেকে অতীব হীন ও অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করো।

ঘুম থেকে ওঠার আদব

ফজরের আগে ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করবে। তখন তোমার অন্তর ও যবানের প্রথম শব্দ যেন হয় আল্লাহর যিকর। এ সময় বলবে,

الحمدلله الذي أحيانا بعدما أماتنا وإليه النشور، أصبحنا وأصبح الملك لله، رب العالمين، أصبحنا على فطرة والعظمة والسلطان الله، والعزة والقدرة الله الاسلام، وعلى كلمة الاخلاص، وعلى دين نبينا محمد صلى الله عليه وسلم، وعلى ملة أبينا إبراهيم حنيفا مسلما وما كان من المشركين؛ اللهم بك أصبحنا، وبك أمسينا، وبك نحيا، وبك نموت، وإليك النشور؛ اللهم إنا نسألك أن تبعثنا في هذا اليوم إلى كل خير، ونعوذ بك أن نجترح فيه سوءا أو نجره إلى مسلم، أو يجره أحد إلينا؛ نسألك خير هذا اليوم وخير مافيه ونعوذ بك من شر هذا اليوم وشر ما فيه

আল্লাহরই প্রশংসা, যিনি মৃত্যুর পরে জীবন দিয়েছেন এবং তাঁর নিকটেই প্রত্যাবর্তন। আমরা সকালে উপনীত হয়েছি, রাজত্বও দিবাভাগে উপনীত হয়েছে। তাঁর জন্যই সকল মহত্ত্ব ও বড়ত্ব, সকল মর্যাদা ও শক্তি-সামর্থ্য। আমরা স্বভাবসিদ্ধ বিশ্বাস, একনিষ্ঠ বাক্য, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনিত দ্বীন এবং আমাদের পূর্বপুরুষ ইবরাহীমের মিল্লাতের ওপর একনিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠিত থেকে মুসলিম হয়ে সকালে উপনীত হয়েছি, আমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। হে আল্লাহ! আপনার কর্তৃত্বে আমরা সকালে প্রবেশ করলাম, আপনারই কর্তৃত্বে থেকে বিকেলে প্রবেশ করলাম। আপনার কর্তৃত্বে আমাদের জীবন, আপনারই কর্তৃত্বে আমাদের মরণ। হে আল্লাহ! আপনার কাছে এই দিনের প্রতিটি কল্যাণ আমরা চাই এবং এই দিনের সকল অমঙ্গল থেকে আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি, কোনো মুসলিমকে ক্ষতি করা থেকে কিংবা কেউ আমাদের ক্ষতি করবে তা থেকে। আপনার কাছে এই দিনের কল্যাণ কামনা করি ও যত কল্যাণ এর মাঝে আছে এবং আপনার কাছে এই দিনের অকল্যাণ থেকে আশ্রয় চাই ও যত অকল্যাণ এর মাঝে আছে।”১২

তুমি যখন পোশাক পরিধান করবে, তখন নিজের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্যের নিয়্যাত করে নেবে। তোমার নিয়্যাত যেন বাহ্যাড়ম্বর ও প্রদর্শন না হয় এ ব্যাপারে সাবধান থাকবে, অন্যথায় তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

শৌচাগারে প্রবেশের আদব ..

তুমি যখন শৌচাগারে প্রবেশ করবে তখন বাম পা দিয়ে ঢুকবে ও ডান পা দিয়ে বেরুবে। আল্লাহ ও রাসূলের নাম লেখা আছে এমন কিছু সাথে নিয়ে প্রবেশ করবে না। তেমনি খালি মাথায় কিংবা খালি পায়েও ঢুকবে না।

শৌচাগারে প্রবেশের আগে পড়ে নেবে, “আল্লাহর নামে, আমি সকল নোংরা ও অপবিত্রতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই, কলুষতাকারী কলুষ থেকে, অভিশপ্ত শয়তান থেকে।” বের হওয়ার সময় বলবে, “আপনার কাছে ক্ষমা চাই। প্রশংসা সেই সত্তার যিনি আমাকে বের করে এনেছেন যা আমাকে কষ্ট দেয় তা থেকে এবং যা আমাকে উপকার করে তার ওপর প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন।”

শৌচকার্য শুরু করার আগেই পরিষ্কারক প্রস্তুত রাখবে। যেখানে শৌচকার্য করেছ সেখানে পানি খরচ করবে না। গলা খাকারি দিয়ে, বাম হাত দিয়ে তিনবার (পুরুষাঙ্গ) চেপে ধরে সকল প্রস্রাব বের করে দেবার চেষ্টা করবে।

যদি মরুভূমিতে হয় তবে মানুষের দৃষ্টিসীমা থেকে দূরে চলে যাও। যদি নিজেকে আড়াল করার মত কিছু পাও তবে পেছনে দিয়ে নাও। যেখানে শৌচকার্য সম্পন্ন করতে চাও সেখানে যাওয়ার আগে নিজেকে উন্মুক্ত করবে না। সূর্য কিংবা চাঁদকে সরাসরি সামনে বা পেছনে রেখে বসবে না। একইভাবে কিবলাকে সামনে কিংবা পেছনে রেখেও বসবে না। মানুষ যেখানে জড়ো হয়, কথা বলে কিংবা ছায়া নেয় সেখানে বসবে না। স্থির জলপ্রবাহে, ফলদায়ী গাছের নিচে কিংবা কোনো প্রাণীর আবাসস্থল গর্তে শৌচকার্য করবে না। শক্ত মাটির ওপর কিংবা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে এমন স্থানেও বসবে না, যাতে প্রস্রাবের ছিটা কিংবা বাতাসে মাধ্যমে গায়ে লেগে যাওয়া থেকে বেঁচে থাকতে পারো, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “এর কারণে কবরের আযাব হয়।”[১০]

বাম পায়ের ওপর ভর দাও এবং একান্ত প্রয়োজন ছাড়া দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করবে না। পাথর (বর্তমান সময়ে টয়লেট পেপার) ও পানি উভয়ই ব্যবহার করো; আর যদি কেবল একটিই ব্যবহার করতে চাও তবে পানিই উত্তম।

(মলত্যাগের ক্ষেত্রে) যদি শুধু পাথর ব্যবহার করতে চাও তবে অবশ্যই তিনটি 
শুকনো পাথর দিয়ে ভালোমত অপবিত্রতা মুছে পরিষ্কার করে নেবে, যাতে অন্যদিকে তা ছড়াতে না পারে। (প্রস্রাবের ক্ষেত্রে) বড় পাথরের তিনটি পৃথক পৃথক অংশ ব্যবহার করো। যদি তিনটি পাথর পবিত্র হওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনে না হয়, তবে পাঁচ, সাত কিংবা এর চেয়ে বেশিসংখ্যক পাথরও ব্যবহার করতে পারো, তবে বেজোড় সংখ্যকই পছন্দনীয়, তবে পরিপূর্ণ পবিত্রতা অর্জন আবশ্যক। পবিত্র হতে বাম হাত ব্যবহার করবে। পবিত্রার্জন শেষে বলবে, “হে আমার রব! আমাকে নিফাক বা দ্বিমুখীতা থেকে এবং আমার গোপনাঙ্গকে অশ্লীলকর্ম থেকে বাঁচিয়ে রাখো।” ধুলিময়লাযুক্ত মাটির ওপর কিংবা দেয়ালের ওপর (কিংবা সাবানের মাধ্যমে) হাত ঘষে নাও। এরপর পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নাও।

ওযুর আদবা১৪]

শৌচকার্যের পর পবিত্র হয়ে মিসওয়াক দিয়ে দাঁত মাজার ক্ষেত্রে অবহেলা কোরো না যেন, কেননা মিসওয়াক মুখ পরিষ্কারক, রবের সন্তুষ্টিদায়ক ও শয়তানের অসন্তুষ্টিদায়ক৷৷৷৷৷ কেননা “মিসওয়াক করে একবারের সালাত মিসওয়াক করে সত্তরবারের সালাতের চাইতে উত্তম।” আবু হুরায়রা সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ বর্ণিত আছে,

لولا أن أشق على أمتي لأمرتهم بالسواك في كل صلاة

“আমার উম্মাতের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে এই আশঙ্কা না থাকলে প্রত্যেকের সালাতের (আগে) আমি মিসওয়াক করার আদেশ দিতাম।”

তিনি আরও বলেন,
أمرت بالسواك حتى خشيت أن يكتب علي

“আমাকে মিসওয়াকের আদেশ দেওয়া হয়েছে এমনকি আমার ভয় হচ্ছিলো না জানি একে ফরয করে দেওয়া হয়!”৷১৮।

কিবলার দিকে মুখ করে ওযু করো, একটু উঁচু স্থান নির্ধারণ করে নেবে যাতে পানি ছিটে তোমার দিকে না আসে। বলো,

وقل رب أعوذ بك من همزات الشياطين (79) وأعوذ بك رب أن يحضرون (۸۹)

“আর বলো, হে আমার প্রভু! শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আমি তোমার আশ্রয় চাই। হে প্রভু! আমার কাছে তাদের উপস্থিতি থেকেও আমি তোমার আশ্রয় চাই।”৷১৯।

কোনো পাত্রে হাত ডুবানোর পূর্বে তিনবার হাত ধুয়ে নাও এবং বলো,

“হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে সৌভাগ্য ও বারাকাহ চাই এবং দুর্ভাগ্য ও ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাই।"||

এরপর অপবিত্রতার অবস্থা দূরীকরণ ও সালাতের শর্ত পূরণের নিয়্যাত করে নাও। মুখ ধোয়ার পূর্বেই তোমাকে নিয়্যাত করে নিতে হবে, অন্যথায় তোমার ওযু হবে না। অঞ্জলী ভরে পানি নাও এবং তিনবার মুখের ভেতরে পানি নিয়ে ধৌত করো। এটা নিশ্চিত করবে যে, পানি মুখের ভেতরে পৌঁছাচ্ছে, সিয়াম থাকলে তার কথা ভিন্ন। তখন বলো, “হে আল্লাহ! আপনার কিতাবের তিলাওয়াতে ও যিকরে আমাকে সাহায্য করুন। দুনিয়া ও আখিরাতে দৃঢ় কথা দিয়ে আমাকে প্রতিষ্ঠিত রাখুন।”

তারপর অঞ্জলী ভরে পানি নিয়ে নাকে দাও, এর ভেতরে প্রবেশ করাও এরপর ঝেড়ে ফেলে দাও। এরকম তিনবার করো। নাকে পানি দেওয়ার সময় বলবে, “হে রব! জান্নাতের ঘ্রাণ নেওয়ার সামর্থ্য দিন ও আপনি আমার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যান।” নাক ঝাড়ার সময় বলবে, “হে আল্লাহ! জাহান্নামের দুর্গন্ধ ও এর অধিবাসীদের অকল্যাণ থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাই।”

তারপর অঞ্জলী ভরে পানি নিয়ে মুখমণ্ডল ধুয়ে নাও, ওপরের কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত এবং এই কান থেকে ওই কান পর্যন্ত। কপালের পার্শ্বদেশ, যেখান থেকে মহিলারা নিজেদের চুল গুছিয়ে থাকে এবং কানের ওপর ও কপালের কোণের যেই অংশ মুখমণ্ডলের অংশ বলে পরিচিত, সেখানে পানি পৌঁছাও।

পশম গজায় এমন চার স্থান, যথাঃ ভ্রূ, গোঁফ, চোখের পাতা ও গণ্ডদেশে পানি পৌঁছাও। দাড়ি পাতলা হলে গোড়ায় পানি পৌঁছানো জরুরী, তবে ঘন হলে দরকার নেই, সেক্ষেত্রে আঙুল দিয়ে খিলাল করা পরিত্যাগ করবে না। মুখমণ্ডল ধোয়ার সময় বলবে, “হে আল্লাহ! কিয়ামতের দিন আপনার বন্ধুদের মুখমণ্ডল যেমন উজ্জ্বল হবে আমার মুখকেও আপনি তেমনি উজ্জ্বল করে দিন। সেদিন আপনার শত্রুদের মুখমণ্ডল যেমন মলিন হবে আমার মুখকে দয়া করে তেমন মলিন করে দেবেন না।”

তোমার ডানহাতকে কনুই পর্যন্ত তিনবার ধোও, একইরকমভাবে বামহাতও ধুয়ে নাও, কেননা ওযুর স্থানগুলো কিয়ামতের দিন উজ্জ্বল হবে। ডানহাত ধোয়ার সময় বলো, “হে আল্লাহ! আমার আমলনামা ডান হাতে দিন এবং হিসাবকে সহজ করুন” আর বামহাত ধোয়ার সময় বলবে, “হে আল্লাহ! আমার আমলনামা বামহাতে কিংবা পেছন দিক থেকে দেওয়া হবে এমন অবস্থা থেকে মুক্তি চাই!”

এরপর হাত ভিজিয়ে মাথা মুছে নাও, এমতাবস্থায় তোমার ডান ও বামহাতের আঙুলগুলো যেন একত্রিত থাকে, চূর্ণকুন্তল থেকে শুরু করে মাথার শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে আবার সামনের দিকে নিয়ে আসো। এভাবে তিনবার করো, শরীরের অন্যান্য অংশেও এমনটা করো। এরপর বলো,

“হে আল্লাহ! আমার ওপর রহমত ও নিয়ামতের অঢেল বর্ষণ করুন। যেদিন আপনার ছায়া ব্যতিরেকে আর কোনো ছায়া থাকবে না সেদিন আপনার আরশের ছায়ার আমাকে স্থান দিন। হে আল্লাহ! আমার চুল ও চামড়াকে জাহান্নামের আগুনের জন্য নিষিদ্ধ করে দিন।”

এরপর নতুন পানি নিয়ে কানের ভেতর ও বাহির ধুয়ে নাও। কানের ভেতরে তর্জনী ঢুকিয়ে ও বাহিরের অংশ বৃদ্ধাঙ্গুলীর মধ্যাংশ দিয়ে পরিষ্কার করো এবং বলো, “হে আল্লাহ! আমাকে তাদের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে নিন যারা আল্লাহর কিতাব শোনে ও সেখান থেকে উত্তম বিষয়ের অনুসরণ করে। হে আল্লাহ! আপনার আনুগত্যশীল বান্দা ও জান্নাতের দিকে আহ্বানকারীদের সাথে থাকার সামর্থ্য দিন।”

এরপর ঘাড় মুছে নাও এবং বলো, “হে আমার রব! আমার ঘাড়কে জাহান্নামের আগুন এবং শাস্তির শেকল ও বন্ধন থেকে মুক্ত করুন।”

এরপর টাখনুসমেত আগে ডানপা আর তারপর বামপা ধুয়ে নাও। বামহাতের কনিষ্ঠ অঙ্গুলী দিয়ে পায়ের আঙুলের মাঝে চালনা করো, ডানপায়ের কনিষ্ঠ আঙুল থেকে শুরু করে বামপায়ের কনিষ্ঠ আঙুলে যেয়ে শেষ করো। (ডানপায়ের) কনিষ্ঠ আঙুল ধোয়ার সময় বলবে, “হে আমার রব! আমার পদযুগলকে সেদিন স্থির রাখুন যেদিন পদসমূহ পিছলে জাহান্নামের আগুনে পতিত হবে” আর বামপায়ের কনিষ্ঠ আঙুল ধোয়ার সময় বলো, “হে আমার রব! আমার পদযুগলকে সেদিন পিছলে যাওয়া থেকে রক্ষা করুন যেদিন মুনাফিকদের পদসমূহ পিছলে যাবে।” জঙ্ঘাস্থির অর্ধেক পর্যন্ত পানি পৌঁছে দাও এবং নিশ্চিত হয়ে নেবে যে, প্রত্যেকটি কাজই তিনবার করে করা হয়েছে কিনা। গোটা ওযু শেষ করে বলবে,

اشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأشهد أن محمد عبده ورسوله، تسبحانك اللهم وبحمدك، أشهد أن لا إله إلا أنت، أنت التواب الرحيم، اجعلني من التوابين؛ واجعلني من المتطهرين، واجعلني من عبادك الصالحين واجعلني صبورا، شكورا، واجعلني أذكرك ذكرا كثيرا، وأسبحك بكرة وأصيلا

“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ভিন্ন কোনো মা'বুদ নেই, তাঁর কোনো অংশীদার নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ আপনার জন্য সকল পবিত্রতা ও প্রশংসা, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি ভিন্ন কোনো মা'বুদ নেই। আমি মন্দকর্মের মাধ্যমে নিজের ওপর যুলম করেছি, আপনার কাছেই ক্ষমাপ্রার্থনা করি ও আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তন করি। আমাকে মার্জনা করে আমার তাওবা কবুল করে নিন, নিশ্চয়ই আপনি তাওবা কবুলকারী ও মহাদয়াময়। হে আল্লাহ! আমাকে তাওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আপনার নেককার বান্দাগণের মাঝে আমায় শামিল করে নিন। আমাকে সবরকারী ও শুকরিয়া আদায়কারীদের কাতারে টেনে নিন। আমার অবস্থা এমন করে দিন যাতে আমি অধিকহারে আপনাকে স্মরণ করতে ও সকাল-সন্ধ্যা আপনার মহত্ত্ব ঘোষণা করতে পারি।”

ওযু শেষে এই দুআ পড়া হলে তার শরীর থেকে সকল পাপ মুছে যাবে, তার ওযুকে কবুল করে নেওয়া হবে এবং আরশের নিচে তাকে স্থান দেওয়া হবে, সেখানেই তা অবস্থান করবে ও আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা ও প্রশংসা পাঠ করতে থাকবে। তার জন্য এর পুরষ্কার কিয়ামত দিবস পর্যন্ত লেখা হতে থাকবে। তবে অবশ্যই ওযুতে সাতটি কাজ থেকে বিরত থাকবেঃ

ক. এমনভাবে হাত ঝাড়া দেবে না যাতে পানি ছিটে আসে

খ. মাথায় ও মুখমণ্ডলে পানির ঝাঁপটা দেবে না

গ. ওযু করার সময় জাগতিক কথাবার্তায় লিপ্ত হবে ঘ. কোনো অঙ্গ তিনবারের অধিক ধৌত করবে না

না।

ঙ. কেবলমাত্র সন্দেহের বশে প্রয়োজনাতিরিক্ত পানি ব্যয় করবে না, কেননা যারা এরকম সন্দেহ করে, ওয়ালহান নামক শয়তান তাদের সাথে খেলা করতে শুরু করে দেয়

চ. দীর্ঘক্ষণ সূর্যের আলোতে রেখে দেওয়া ও খা

ছ. পিতলসৃষ্ট পাত্রের পানি দিয়ে ওযু করবে না।

[২১] আয়িশাহ রাদি সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীছে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্যের আলোতে রেখে দেওয়া পানি দিয়ে ওযু করতে নিষেধ করেছেন, কেননা এতে কুন্ঠরোগের সম্ভাবনা থাকে- হাইছামী, মাজমাউয যাওয়াঈদ, ১০৭৬। এ সম্পর্কে ইমাম নববী বলেন,

المشهور من مذهبنا كراهة الطهارة بالماء المشمس (والمختار) أنه لا يكره لأن الحديث المروي فيه عن عائشة ، والأثر عن ابن عمر رضي الله تعالى عنهما ضعيفان جداء وخوف البرص لا يعرفه إلا الأطباء. وقال الشافعي:

المشمس إلا أن يكون من جهة الطب

“আমাদের মাযহাবের বিখ্যাত মত হচ্ছে যে, সূর্যোত্তপ্ত পানি ব্যবহার করা মাকরুহ বা অপছন্দনীয়। কিন্তু আসলে এই পানি ব্যবহার মাকরুহ নয়, কেননা এ ব্যাপারে আয়িশাহ রাদি. এর হাদীছ ও ইবনু উমার বর্ণিত আছার দুটি খুবই দুর্বল। আর কুন্ঠের সম্ভাবনার কথা একমাত্র চিকিৎসক ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। ইমাম শাফিঈ বলেছেন, 'চিকিৎসাসংক্রান্ত কারণ ছাড়া সূর্যোত্তপ্ত পানি ব্যবহার মাকরূহ নয়।” ফতোয়ায়ে ইমাম নববী, পৃঃ ১৭,
আরো পড়তে অথবা দেখতে :- অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন।
      We Respect Every Author Hardwork :- boipaw.com™

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ