আই ফিয়ার আল্লাহ লেখক : আয়মান আশ্রাফ | I Fear Allah By Ayman Ashraf
“একটু লক্ষ করুন! পকেটে দামী স্মার্টফোন রাখতে, মানিব্যাগ নিতে আমাদের মনে থাকে। অথচ সেই একই পকেটে টুপি আর মিসওয়াক রাখার কথা বেমালুম ভুলে যাই।”
- বই : আই ফিয়ার আল্লাহ
- লেখক : আয়মান আশ্রাফ
- প্রকাশনায় : ফিলহাল প্রকাশন
- প্রচ্ছদ : আহমাদুল্লাহ ইকরাম
- সম্পাদনা : মুহাম্মাদুল্লাহ আহনাফ
- প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০২২
- বইমেলা পরিবেশক : বাংলার প্রকাশন
- মূল্য : ২০০ টাকা।
পাঠ্য অনুভূতি : বেশ কয়েকদিন গত হয়েছে বইটা হাতে পেয়েছি। নানান ব্যস্ততা, মন খারাপ, শরীর খারাপ সবকিছু মিলিয়ে বই পড়া হচ্ছে না। শুধু বই পড়া না কোনো কাজেই মনোযোগ বসছে না। প্রায়ই ছয়দিন ধরে আয়মান ভাইয়ের লেখা “আই ফিয়ার আল্লাহ্” একটু একটু করে পড়ে যাচ্ছি। পড়েই যাচ্ছি। একটু পড়ি একটু ঘুমাই। এভাবে ৬ দফা ঘুমানোর পর বইটা শেষ হলো। তাও গভীর রাতে ঘুম না আসার ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করে পড়ে বইটা অবশেষে রাখলাম।
আমাদের বর্তমান যুগকে বলা যায় ফেতনার যুগ। অনেকেই অনলাইন জগত পেয়ে আখেরাত জীবনে কি হবে সেটা ভুলেই গিয়েছে। অন্য ধর্মের মানুষ দুনিয়ার লোভে বিগড়ে গেলে চিন্তা সমস্যা নেই। কিন্তু ইসলাম ধর্মের মানুষ বিগড়ে গেলে আমাদের সমস্যা। শুধু সমস্যা না মারাত্মক সমস্যা।
এবার আসি বইয়ের কথায়..
মোট ১১টি গল্প নিয়ে বইটা সাজানো। ১১টি গল্প ১১টপিকে লেখা। ১১টি শিক্ষা। এ বিষয়টা ভালোলাগার মতো। আয়মান আশ্রাফ একজন নতুন লেখক। নবীন হয়ে ধর্মের বিষয় নিয়ে লেখালেখি চালিয়ে যাওয়াটা অনেকে পারে না। সাহস লাগে। ধর্মীয় লেখায় কারো তেমন উৎসাহ দেখা যায় না আজকাল। তাই মনোবল হারিয়ে ফেলাটাই স্বাভাবিক। ভীষণ ভালো লেগেছে প্রতিটি গল্প খুব সুন্দর করে লেখার জন্য। গল্পগুলো পড়ে খুব সুন্দর করে একটা একটা করে শিক্ষা নেয়া যায় এমন একটি বই “আই ফিয়ার আল্লাহ! ”
বই পড়াটা আমরা অনেকেই বিনোদনের জন্য মনে করে থাকি। এটার সাথে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার জন্য বই পড়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এটাও মনে রাখা উচিত। ছোট বড় সবাই বইটি পড়তে পারবে। আশা করি, বইটি যে পড়বে তার ভালো লাগবে। ভালো কিছু শিখবে। আয়মান আশ্রাফ! তোমার জন্য শুভ কামনা। দোয়া রইলো পরবর্তীতে যাতে আরো গুছিয়ে লিখতে পারো।
আলোচনা-সমালোচনা: প্রকাশনী হয়তো নতুন। তবুও খুব সুন্দর সম্পাদনা করে বইটা প্রকাশ করেছেন। প্রচ্ছদটা বেশ সুন্দর। একদম বইয়ের লেখার মত সুন্দর।
কিছু শব্দে ভুল ছিল। পুরো একটা বইয়ে ভুল থাকবে স্বাভাবিক। একটা গল্পে চরিত্রের নড়বড় হয়েছে। এটা হয়তো লেখক, না দেখেই গুলিয়ে ফেলছেন।
লেখাকে আরো গুছাতে হবে। আশা করি, পরবর্তীতে অনেক সুন্দর কিছু পাব। ইন শা আল্লাহ। দোয়া রইলো।
এসব কিছু মিলিয়ে পুরো বইটা একদম ভালো লাগার মতো। আমি বলব, সবাই একবার হলেও বইটা পড়ে দেখুক। বইটা পাঠকপ্রিয় হোক। বইয়ের কথা ছড়িয়ে পড়ুক। নবীনেরা আমাদের জন্য এভাবেই সুন্দর কিছু নিয়ে আসুক।
Buddodeb Bosu
Catherine Neville
Chowdhury Shamsul Arefin
আই ফিয়ার আল্লাহ’ আয়মান আশ্রাফের এমনই একটি জীবনঘনিষ্ঠ গল্পভাষ্য। যেখানে লেখক তার সমস্ত ভালোবাসা ও বুদ্ধিমত্তা ঢেলে দিয়ে কুরআন-হাদিসের মিশেলে আমাদের বাস্তব জীবনের গল্পগুলোই তুলে ধরেছেন।
লেখক তার গল্পগুলোর বুনন এত নিপুণ ও বস্তুনিষ্ঠ করে তুলেছেন যে, তার প্রতিটি চরিত্র যেন খোদ আপনার জীবনে খুব স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। গল্পগুলোর আরেকটি সুচারুতা হলো তা একটি শিরোনামে সীমাবদ্ধ না বরং বিভিন্ন শিরোনামে বিবৃত হয়েছে, যা দ্বারা আপনি আপনার জীবন চলার পাথেয় সম্বন্ধে জানতে পারবেন এবং তা থেকে ফায়দা হাসিল করতে পারবেন, ইন শা আল্লাহ।
এশার নামাজ শেষ হয়েছে সবে। নিচু স্বরে সূরা মুলক পড়ছি। এমন সময় টেবিলে থাকা ফোনটা হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠল। সূরাটা শেষ করে ফোনের দিকে হাত বাড়ালাম। ছোট ভাই জাবের মেসেজ পাঠিয়েছে। বাবার সাথে ভোলা ফিরছে সে। মনে পড়ল, ঢাকায় গিয়েছে বেশ অনেকদিন হলো। এতদিনে বাড়ি ফেরার ফুরসত মিলল তবে। ঢাকা থেকে ভোলা ফেরার রাস্তাটা ভারি অদ্ভুত। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা তিন তিনটি বড় নদীই পাড়ি দিতে হয়। গোটা একখানা রাত কাটাতে হয় নদীর বুকে। জাবেরের মনে নিশ্চয়ই অপার আনন্দের হিল্লোল বইছে।
চোখের তারায় ধীরে ধীরে ভেসে উঠল পদ্মার বুক চিরে বয়ে চলেছে একটি লঞ্চ। পতঙ্গের মতো সাঁই সাঁই করে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। দুপাশ থেকে একটি নির্দিষ্ট ছন্দে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসছে। খোলা জানালা বেয়ে একটুখানি হিমেল হাওয়া বয়ে গেল হঠাৎ। গোটা শরীরকেই আলিঙ্গন করে গেল যেন। লঞ্চের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই অদূরে চোখে পড়ে মাঝিমাল্লার দল। প্রতিটি ছইয়ের ভেতরেই হারিকেনের টিমটিমে আলো জ্বলছে। ঢিমে আলোতে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে জেলেদের কারগুজার। কেউ রান্না করছে, কেউবা এগিয়ে দিচ্ছে রান্নার সরঞ্জাম। কেউ আবার মনের সুখে গলা খুলেছে দুনিয়া সুন্দর, আসমান সুন্দর...
হঠাৎ-ই লঞ্চের পাশ ঘেঁষে থাকা একটা নৌকায় চোখ পড়ল। মাঝির ঠিক পাশে বসে আছে এক ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ। শুভ্র দাড়ি, এলোমেলো কাঁচাপাকা চুল, মাথায় প্যাঁচানো বিবর্ণ গামছা, গায়ে ছেঁড়াফাড়া গেঞ্জি। নিতান্তই সাধারণ এক বৃদ্ধ। তবে অন্য একটি ব্যাপার তাকে করে তুলেছে অসাধারণ। চোখদুটো বুজে একমনে জিকির করছে সে-"আল্লাহু আল্লাহু।" কয়েক গজ দূরে থাকা লঞ্চ থেকেও অস্পষ্টভাবে সেটা শুনতে পেলাম যেন। খেই হারিয়ে ফেলতে লাগলাম।
সহসা ফোনের কাঁপনে আমার সংবিৎ ফিরল। আরেকটা মেসেজ। জাবের নয়; সিম কোম্পানি।
বাবা আজ বাড়ি ফিরছে বলে তানুর খুশি যেন বাঁধ মানছে না। এক দণ্ড বসার জোঁ নেই কোথাও। ইতিউতি করে ছুটোছুটি করছে সারা বাড়িময়। আর একটু পরপর এসে আমার কানে নিজের খুশির জানান দিচ্ছে।
‘এই-যে ভাইয়া! বাবা যে বাড়ি আসছে সে খবর তোমার আছে? তোমার আর খবর রেখে কাজ নেই। আমি আছি না? বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে!” কথাগুলো বলেই তানু এক গাল হেসে দিল।
“আর শোনো ভাইয়া! বাবা কিন্তু আমার জন্য এত্ত এত্ত মজা আনবে। তখন আবার ভাগ বসাতে এসো না। তোমাকে কিন্তু কিচ্ছুটি দিব না, হুমম।”
“আরে ভাইয়া আসল কথা তো বলাই হয়নি!” তানুর কথা ফুরোয় না। “আব্বু আমার জন্য চকলেটও আনবে। কী মজা! তোমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাব।”
তানু, আমার ছোট বোন। ক্লাস এইটে উঠেছে সবে। কিন্তু দস্যিপনা এখনও যায়নি।
হাবভাব দেখে মনেই হয় না বয়স এত হয়েছে।
নীরব দর্শকের মতো তার হড়বড়ে বকবকানি শুনে গেলাম। মনে মনে অবশ্য হাসি পেয়েছে খুব। তবুও রেহাই নেই। আজ তার কথার ফুলঝুরি থামবে বলে মনে হচ্ছে আমাকে চুপ থাকতে দেখে একটা খোঁচা দিয়ে আবার শুরু করল তার সংবাদ সম্প্রচার
“ভাইয়া, জানো কী হয়েছিল?”
“না, জানি না তো। না বললে জানব কী করে?” অবশেষে আমি নীরবতা ভাঙলাম।
“তাই তো!” বিজ্ঞ লোকের মতো সে মাথা চুলকোয়। “হয়েছে কী, পাশের বাসার তৃষামণিকে আজ তার আম্মু অনেক মেরেছে!”
আমি বেশ অবাক হলাম
কেন! কেন?”
“মারবে না? সে ঠিকমতো নামাজ পড়ে না। মাথায় কাপড় দেয় না। সকালে
মক্তবেও যায় না। আন্টিকে রান্নার সময়ওতো হেল্প করে না। তাহলে মারবে না কেন?” মুখটা একটু গম্ভীর করে জবাব দিলাম- “এইটুকুন একটা মেয়ে। তার গায়ে হাত
তোলাটা একদমই ঠিক হয়নি। বুঝিয়ে বলা উচিত ছিল।”
তানু আমার কথায় সায় দিল— “তাই তো। ছোট ছেলেমেয়েদের গায়ে হাত তুলতে নেই। তাদেরকে বুঝিয়ে বলতে হয় সব। একেবারে সবকিছু হাতে ধরিয়ে শিখিয়ে দিতে হয়। যেমনটা তোমরা আমাকে দাও।”
তানুর মুখে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠলো।
রাত অনেক হয়েছে। ভাইবোনের খুনশুটি পর্ব শেষ করে ঘুমাতে এলাম। তানুটা আরো গল্প করতে চেয়েছিল অবশ্য। একপ্রকার জোর করেই তাকে ঘুমাতে পাঠিয়েছি। দিন দিন যা গল্প বলিয়ে হচ্ছে মনে হচ্ছে আমার পাগলী বোনটা খুব বড় হয়ে গিয়েছে। আর পারি না!
নিশুতি রাত। পিনপতন নীরবতা চারদিকে। পিনপতন বললে অবশ্য ভুল হবে। একটু মনোযোগ দিলে শোনা যাবে ঝিঁঝিঁ পোকার সমবেত সংগীত! হঠাৎ শিথানে রাখা মোবাইলটা বেসুরে কেঁপে উঠল। এলার্ম বাজছে। আনমনেই হাতড়াতে লাগলাম বালিশের নিচে। ঘুম ঘুম চোখে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি চারটা বাজে।
পাশ ফিরতেই দেখি পাশের ঘরটায় আলো জ্বলছে। কেউ মিনমিন করে কিছু বলছে আর ডুকরে কাঁদছে। আমি নিশ্চিত এটা আর অন্য কেউ নয়, আমার আদরের ছোট বোন তানু। তাহাজ্জুদের সময় দুআ কবুল হয়, এমনটা শোনার পর থেকে এটা তার দৈনন্দিন কাজ। যা কিছু দরকার, সব তাহাজ্জুদের মুনাজাতে আল্লাহকে বলে।
এদিকে অধম আমি। বয়সে ওর বড় হয়েও একটা দিন ওর আগে জাগতে পারি না। তাহাজ্জুদ নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর শ্রেষ্ঠ নামাজ—এটা আচানক মনে পড়ে গেল। এরপর এক এক করে তাহাজ্জুদ সংক্রান্ত সব আয়াত-হাদিস স্মৃতির পাতায় ভিড় করতে লাগল।
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সুরায় তাহাজ্জুদ নামাজের প্রতি তাগিদ দেয়া হয়েছে। যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যেতে পারবেন, তাদের মধ্যে একশ্রেণির মানুষ হলেন তারা, যারা পরম যত্নের সাথে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেন।
নবিজি সা. বলেছেন, "রমজানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোজা হলো মুহাররমের রোজা।
আর ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো রাতের (তাহাজ্জুদের) নামাজ।"
নবিজি আরও বলেন, "আল্লাহ প্রতিদিন রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিচের আসমানে অবতরণ করেন এবং বান্দাদের উদ্দেশ্যে বলেন, কে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দান করব। আর কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করব।"
কিন্তু আফসোস! আমরা তখন থাকি গভীর ঘুমে। যেন আমাদের কোনো অভাব নেই, কারো কিছু চাওয়ার নেই। শেষ রাতে প্রভুর ডাকে সাড়া দেয়, এমন মানুষ খুব কম আছে। আর যারা সাড়া দেন তারা নিঃসন্দেহে সাচ্চা মুমিন।
ছোট বোনটার জন্য নিজের অজান্তেই মন থেকে দুআ আসলো-জাজাকিল্লাহু খাইরান ফিদ্দারাইন।
পাগলি বোনটাও বোধহয় কেঁদেকেটে আমাদের জন্য দুআ করছে। দুআতে মালিকের কাছে কী কী চাইছে কে জানে। ইস, পৃথিবীর সব মানুষই যদি তানুর মতো তাহাজ্জুদগুজার হতো!
আমি আর কালক্ষেপণ করলাম না। উঠে ওজু সেরে তাহাজ্জুদ আদায় করে নিলাম। ফজরের জন্য অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। খানিকক্ষণ বাদেই অন্তর শীতল করা কণ্ঠে মসজিদের মিনার হতে ফজরের আজান ভেসে আসলো। সুমধুর সেই ধ্বনি যেন প্রকৃতিকে মোহাবিষ্ট করে ফেলল।
এই পৃথিবীতে আজানের আওয়াজের চেয়েও উত্তম কোনো আওয়াজ আছে কি না, আমার জানা নেই। কী সুন্দর এক আহ্বান- তোমরা সফলতার দিকে আসো, নামাজের দিকে আসো, ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম; সর্বোত্তম!
পরিপাটি হয়ে মসজিদের দিকে হাঁটা দিলাম। চৌরাস্তার মোড়ে আসতেই কয়েকজন মুরুব্বির সাথে দেখা। সবাই মসজিদে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ একটু পরপর 'হাইয়্যা আলাস সালাহ বলে রব তুলছেন। কেউ আবার 'আল্লাহু আকবার' ‘সুবহানাল্লাহ’ বলে সশব্দে জিকির করছেন।
গ্রামের সরু রাস্তাটা ধরে হাঁটছি আমরা। রাস্তার পাশে বাড়ি দেখতেই কয়েকজন মুরুব্বি জোরে জোরে আওয়াজ করে বলছেন- “ভাই সাহেব! উঠেন। নামাজের সময় হইছে। উঠেন। ঘুম থেইকা নামাজ ভালো। উঠেন, উঠেন। ঘুম থেইকা উঠেন।”
নামাজ শেষে এখন মধুমাখা কুরআন তিলাওয়াতের পালা। এরপর বেশ খানিকক্ষণ দুআ আর জিকির শেষে বাড়ির রাস্তা ধরলাম। এতক্ষণে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাখিরাও জেগে উঠেছে আড়মোড়া ভেঙে। গাছের ডালে ডালে পাখিদের কিচিরমিচির সেটাই প্রমাণ করছে। তাদের কলরবে মনটা ভীষণ ফুরফুরে হয়ে উঠতে লাগল।
পাখিদের দেখে আমার খারাপ লাগল। নিজেদের মুসলমান দাবি করি আমরা। অথচ ঘুম থেকে জাগার প্রতিযোগিতায় পাখিরা আমাদের হারিয়ে দেয়। ঘুম থেকে জেগে কোথায় আমাদের উচিত সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুক হিসেবে রবের আরাধনা করা। তা না, আমরা ঘুমে বেহুঁশ।
বাড়িতে পৌঁছে দেখি তানু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। এরপর মনে পড়ল, আজ বাবার আসার কথা। সেজন্য সে চাতক পাখির মতো হা করে পথের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমাকে দেখামাত্রই ফিক করে হেসে দিল। হাসি মাখা মুখে ফটাফট সালাম দিতেও ভুলল না।
সালামের জবাব দিলাম। জুতা খুলতে খুলতে জিগ্যেস করলাম- “ইশরাকের
নামাজ আদায় হয়েছে?”
“কবে।”
তানু উত্তরটা এমনভাবে দিল যেন আরো দুই যুগ আগে পড়ে ফেলেছে। আমি
আরো কিছু বলতে যাব অমনি আঙুলের ইশারায় আমাকে পেছনে তাকাতে বলল।
ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখি বাবা, ছোট ভাইসমেত গাড়ি থেকে নামছেন। বাবার হাতে একটা ব্যাগ। গাঢ় কালো কিন্তু বেশ বড়সড়। জানি না ওতে কী আছে। তবে ব্যাগের আকার আমার কৌতূহল আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর আগে কখনো এমন বড় ব্যাগ বাবার হাতে দেখিনি। আমি এক দৌড়ে বাবার দিকে ছুটে গেলাম।
সালাম-মুসাফাহা শেষ করে বাবার হাত থেকে ব্যাগটা নিলাম। ও আল্লাহ! যেমন
বড়, তেমন ভারী। কী এমন হাতি-ঘোড়া আছে এতে! হাতের বড় ব্যাগটা দেখে তানু বেজায় খুশি। চোখ দুটো ঝলমল করছে আনন্দে। ও হয়তো ভাবছে মুদি দোকানের সব খাবার এই পুটলিতে পুরে বাবা ওর জন্য নিয়ে
এসেছেন।
হাত থেকে ব্যাগটা রাখতে যাব, অমনি তার বায়না শুরু- "ভাইয়া, ব্যাগটা আমি খুলি?"
আমি ধমকে বললাম-"তুই খুলবি কেন? আমি খুলতে জানি না?"
তানু এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। এবার গলাটা একটু খাদে নামিয়ে আহ্লাদী স্বরে বলল-"আরে দে না ভাইয়া। আমি খুললে কী হয়?"
“ঠিক আছে। নে।”
খুশিতে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে তানু ব্যাগ খুলতে লাগল। কিন্তু একি! ব্যাগ খুলে সবার চক্ষু চড়কগাছ।
এত্ত এত্ত বই। বাবা আমাদের জন্য এবার বই এনেছেন। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা বই। বইয়ের প্যাকেটের ওপর আবার সবার নামও লিখা আছে। তানুর বইয়ের প্যাকেটটা হাতে নিলাম। চারটা চমৎকার বই- এসো ইমান শিখি, এসো নামাজ পড়ি, নবি ও রাসুল, আর হে আমার বোন।
ব্যাগভর্তি বই দেখে তো আমার আনন্দের সীমা নেই। যেন হাওয়ায় ভাসছি আমি। পাশ ফিরে দেখি তানুর মুখটা বেলুনের মতো চুপসে আছে। আমি খোঁচা মেরে বললাম-"কী রে তানু। মজা খাবি না?"
বলেই হো হো করে হাসতে লাগলাম।
রাগে-ক্ষোভে তানুর মুখটা লঙ্কার মতো লাল হয়ে গেছে। চেহারায় একটা দুঃখী ভাব এনে খাটের এক কোনায় বসে পড়ল। আর একটু পরপর আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে, উপহার তার পছন্দ হয়নি।
যদিও মনে মনে আমি বেশ মজা পাচ্ছি। তবে সেটা লুকিয়ে মুখে একটা কাঠিন্য এনে তানুকে জিগ্যেস করলাম-"কী হয়েছে?"
মহা বিরক্তির একটা ভাব নিয়ে ঠোঁট উলটিয়ে উত্তর দিল-"ইয়ারকি মেরো না তো ভাইয়া।"
এবার আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। হো হো করে হেসে
দিলাম।
তানু মুখটাকে বাঙলার পাঁচ বানিয়ে রেখেছে। চোখের কোনায় কিছু জল এসে হুটোপুটি খাচ্ছে। কিন্তু গাল বেয়ে নামার অনুমতি পাচ্ছে না। হয়তো পাবেও না। মেয়েটা ভীষণ অভিমানী। কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু কাউকে দেখাবে না। ওর জন্য আমার বেশ মায়া লাগল।
ছোট ভাই আব্দুল্লাহ ইসলাম জাবের। বাবার সাথে কিছুক্ষণ হলো এসেছে। বাসার সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দুভাইবোনের কীর্তিকলাপ দেখছে। তানুর এমন অবস্থা দেখে দৌড়ে এসে ওকে বুকে টেনে নিল। কপালে ছোট্ট একটা চুমো এঁকে দিয়ে বলল-"মন খারাপ করে না বোন। আমরা সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসি।"
হঠাৎ তানুকে ছেড়ে সে রীতিমতো গম্ভীর গলায় বলল-"শোনো! আমি তোমাকে আজ কিছু কথা বলব। কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে কিন্তু।”
Comments
Post a Comment
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....