মুহাররম মাসের আমল - Muharram Masher Amol

মুহাররম মাসের আমল

মুহাররম মাসের আমলের আলোচনা কয়েকটি মাজলিসে বিভক্ত

প্রথম মাজলিস : শাহরুল্লাহ অর্থাৎ মুহাররম মাস ও এর প্রথম দশ রাত্রির ফযীলত

সহীহ মুসলিম-এর বর্ণনায় এসেছে, আবূ হুরায়রা (রদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, নবি (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم وأفضل الصلاة بعد الفريضة صلاة الليل

“রমাদানের সিয়ামের পর সর্বোত্তম সিয়াম হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররমের সিয়াম আর ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হচ্ছে রাতের সালাত (তাহাজ্জুদ) ।”[৩]

এই হাদীস সম্পর্কে আলোচনা দুইটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত করা হয়েছে—

এক সিয়ামের মাধ্যমে নফল আমল এবং

দুই : কিয়াম (তাহাজ্জুদ)-এর মাধ্যমে নফল আমল।

প্রথম পরিচ্ছেদ : সিয়াম পালনের মাধ্যমে নফল আমল করার ফযীলত

উপরিউক্ত হাদীসটি এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল যে, রমাদানের পরে যে সমস্ত সিয়াম

দ্বারা নফল ইবাদাত করা হয়, তার মধ্যে সর্বোত্তম নফল সিয়াম হলো মুহাররম মাসের সিয়াম।

এর এই ব্যাখ্যাও করা হয় যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো : রমদানের পর এটি সর্বোত্তম মাস, যার পুরোটা জুড়ে সাওম পালন করা হয়। তবে কিছু মাসের কিছু সাওম এর ব্যতিক্রম, সেগুলো এর চেয়েও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে। যেমন : আরাফার দিনের সাওম, যুল-হিজ্জাহ মাসের প্রথম দশ দিনের সাওম, শাওয়াল মাসের ছয়টি সাওম ইত্যাদি।

আবার ব্যাপকভাবে নফল সাওমের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম হলো হারাম মাসসমূহের সাওম। নবি (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি এক ব্যক্তিকে হারাম চারটি মাসে সাওম পালনের আদেশ দিয়েছিলেন। আমরা উপযুক্ত স্থানে এর আলোচনা করব, ইন শা আল্লাহ।

হারাম মাসসমূহের মধ্যে উত্তম মাস কোনটি?


এই মাসআলা নিয়ে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

হাসান বাসরি (রহিমাহুল্লাহ)-সহ আরও অনেকেই বলেছেন, “সর্বোত্তম মাস হলো আল্লাহর মাস অর্থাৎ মুহাররম মাস। পরবর্তীদের মধ্য থেকে একটি দল এই অভিমতকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

ওয়াব ইবনু জারীর (রহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেছেন কুররাহ ইবনু খালিদ (রহিমাহুল্লাহ) থেকে, আর তিনি বর্ণনা করেছেন হাসান বারি (রহিমাহুল্লাহ) থেকে, তিনি বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বছরের সূচনা করেছেন সম্মানিত (হারাম) মাস দ্বারা, আবার শেষও করেছেন সম্মানিত মাস দ্বারা। সুতরাং আল্লাহ তাআলার নিকট বছরের মধ্যে রমাদানের পরে মুহাররম মাসের চেয়ে অধিক সম্মানিত আর কোনো মাস নেই। এই মাসটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার কারণে এর নামকরণ করা হয়েছে (আল্লাহর মাস) বলে।'

নবি (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ও মুহাররম মাসকে 'আল্লাহর মাস' বলে অভিহিত করেছেন। আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে এর সমূহ মর্যাদা ও ফযীলত। কারণ সৃষ্ট বস্তুসমূহের মধ্যে যা বিশেষ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ আল্লাহ তাআলা কেবল সেগুলোকেই নিজের দিকে সম্পৃক্ত করেন। যেমন তিনি মুহাম্মাদ,

ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূব (আলাইহিমুস সালাম)-কে ‘তাঁর উবুদিয়্যাত’-এর দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। এমনিভাবে কা'বা এবং সালিহ (আলাইহিস সালাম)-এর উটকে তিনি নিজের দিকে সম্পর্কিত করেছেন (‘বাইতুল্লাহ' ও ‘নাকাতুল্লাহ)।

شهر الحرام مبارك ميمون *** والصوم فيه مضاعف مستون

وثواب صابيه لوجه إلهي *** في الخلي عند مليكه مخزون

হারাম মাস অনেক বরকতপূর্ণ ও সৌভাগ্যময়, এতে রোযা রাখা সুন্নাহ, এতে প্রচুর নেকি হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় রোযাদার তার প্রতিদান, সংরক্ষিত পাবে আপন মালিকের কাছে অফুরান।

রোযা হলো বান্দা ও তার রবের মধ্যে একটি গোপন বিষয়। এ কারণেই (হাদীসে কুদসিতে এসেছে,) আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

كل عمل ابن آدم له، إلّا الصوم، فإنه لي، وأنا أجزي به، إنه ترك شهوته وطعامه وشرابه من أجلي. وفي الجنة باب يقال له الريان، لا يدخل منه إلا الصايمون، فإذا دخلوا، أغلق فلم يدخل منه غيرهم

“আদম সন্তানের প্রতিটি আমল তার নিজের জন্য। তবে সিয়াম ব্যতীত, এটা কেবল আমার জন্য। সুতরাং আমিই এর প্রতিদান দেবো। কারণ সে শুধুমাত্র আমার সন্তুষ্টির আশায় তার যৌনচাহিদা, খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকে। জান্নাতে একটি দরজা আছে, যাকে বলা হয় ‘রাইয়্যান'। এটি দিয়ে কেবল সিয়াম পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের প্রবেশ করা যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন তা বন্ধ করে দেওয়া হবে, ফলে সেই দরজা দিয়ে আর কেউ ঢুকতে পারবে না।”

‘মুসনাদু আহমাদ’-এ এসেছে, আবূ উমামা (রদিয়াল্লাহু আনহু) নবি (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলেন, ‘আমাকে উপদেশ দিন।' জবাবে তিনি বলেন,

عليك بالصوم، فإنه لا عذل له “নিজের ওপর সাওম অপরিহার্য করে নাও। কারণ এর সমকক্ষ আর কিছুই নেই।”

এরপর থেকে আবূ উমামা (রদিয়াল্লাহু আনহু) এবং তাঁর পরিবারের লোকজন সাওম পালন করতে শুরু করেন। যদি দিনের বেলায় কখনো তাদের বাড়িতে ধোঁয়া দেখা যেত, তা হলে জানা যেত যে, তাদের ঘরে মেহমান এসেছে।

সিয়াম পালনকারীর জন্য দুটি খুশি রয়েছে : একটি হলো সিয়াম ভাঙার সময়, আরেকটি হলো তার রবের সাথে সাক্ষাতের সময়, যখন সে তার সিয়ামের প্রতিদান পাবে সংরক্ষিত।

আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

والصايمين والصايمات والحافظين فروجهم والحافظات والذاكرين الله كثيرا والذاكرات أعد الله لهم مغفرة وأجرا عظيما -

“সিয়াম পালনকারী পুরুষ, সিয়াম পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী পুরুষ, যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যিকারী পুরুষ ও অধিক যিকরকারী নারী—তাদের সবার জন্য আল্লাহ প্রস্তুত করে রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।”শি

আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন,

كلوا واشربوا هنيئا بما أسلفتم في الأيام الخالية 2

“অতীতের দিনগুলোতে তোমরা যা করে এসেছে, তার বিনিময়স্বরূপ তোমরা তৃপ্তির সাথে খাও এবং পান করো।”[s]

মুজাহিদ (রহিমাহুল্লাহ)-সহ আরও অনেকেই বলেছেন, 'এটি নাযিল হয়েছে

সিয়াম পালনকারীদের ব্যাপারে।'

যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য খাবার, পানীয় ও যৌনচাহিদা পূরণ করা থেকে বিরত

[৩২] আহমাদ, আল-মুসনাদ, ২২১৪৯; নাসাঈ, ২২২৩।

[৩৩] সূরা আহযাব ৩৩: ৩৫।

[৩৪] সূরা হাক্কাহ, ৬৯ : ২৪।

থাকবে, আল্লাহ তাআলা তাকে এর চেয়েও উত্তম বিনিময় দান করবেন, এমন খাবার ও পানীয় যা কখনো ফুরোবে না এবং এমন সব স্ত্রী, যারা কখনো মৃত্যুবরণ করবে না।

যেহেতু সিয়াম বান্দা ও রবের মধ্যে একটি গোপন বিষয়, তাই মুখলিস বান্দারা খুব সতর্কতার সাথে তা গোপন রাখার চেষ্টা করেন, যাতে কেউ টের না পায় ।

মনীষীদের কেউ একজন বলেছেন, ‘আমাদের নিকট পৌঁছেছে যে, ঈসা (আলাইহিস সালাম) বলেছেন,

إذا كان يوم صوم أحدكم، فليدهن لحيته ويمسح شفتيه من دهنه حتى ينظر إليه الناظر فيظن أنه ليس بضايم

“তোমাদের কেউ যখন সিয়াম পালন করবে, তখন সে যেন তার দাড়িতে তেল লাগায় এবং দুই ঠোঁটেও সামান্য তেল ছোঁয়ায়, যাতে যে তাকে দেখবে, সে যেন ধারণা করে যে, এই ব্যক্তি সিয়াম পালনকারী নয়।।।

আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, “তোমাদের কেউ সিয়াম পালন করলে সে যেন চুলে চিরুনি করে এবং তেল লাগায়। ডান হাতে সদাকা করলে বাম হাত থেকেও যেন গোপন রাখে। আর নফল সালাত আদায় করলে যেন বাড়ির ভেতরে নির্জন কক্ষে তা আদায় করে। ত

আবুত তাইয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'আমি আমার পিতা এবং এলাকার অনেক শাইখদের পেয়েছি, যখন তাদের কেউ সিয়াম পালন করতেন, তেল ব্যবহার করতেন এবং নিজের সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটি পরতেন।’

সালাফদের মধ্যে একজন চল্লিশ বছর যাবৎ সাওম রেখেছেন, কিন্তু কেউ তা জানতে পারেনি। তার একটি দোকান ছিল, প্রতিদিন তিনি বাড়ি থেকে দুটি রুটি নিয়ে দোকানে আসতেন; আর আসার পথে তা সদাকা করে দিতেন। ফলে তার পরিবারের লোকজন জানত, তিনি দোকানে গিয়ে রুটি খেয়ে নেন, অপরদিকে যারা দোকানে থাকত তারা ভাবত, তিনি বাড়ি থেকে আসার সময় খেয়েই আসেন।

[৩৫] ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ, ৩৫৫৪১; আহমাদ, কিতাবুয যুহদ, ৩১৬।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ